ইন. ডেস্ক
তরুণদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। নেপালের সচিবালয় থেকে আজ মঙ্গলবার বিকেলে এক বিবৃতিতে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে তাঁর পদত্যাগের পরও বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গতকাল সোমবার নেপালের রাজপথে নেমে আসেন কয়েক হাজার মানুষ। বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ বা জেন-জি প্রজন্মের। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশটির অন্তত সাতটি শহরে এদিন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ দমনে কঠোর হন অলি সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জন নিহত হন।
বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। এমনকি সরকারের একাধিক মন্ত্রী এ অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন।
আজ ভোর থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীরা আবার জড়ো হতে শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সকালে কাঠমান্ডুসহ কয়েকটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু সেই কারফিউ তরুণদের মিছিল থামাতে পারেনি। এদিনও দুজন নিহত হওয়ার খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
বিক্ষোভ-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ
আজ সকালে কারফিউ উপেক্ষা করে কাঠমান্ডুতে নেপালের পার্লামেন্ট ভবন এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা সর্বশেষ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় শীতল নিবাসে আগুন দেন। তাৎক্ষণিকভাবে এর বেশি কিছু জানা যায়নি।
আজ ভোরে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করে ভক্তপুরের বালকোট এলাকায় প্রধানমন্ত্রী (এখন পদত্যাগ করেছেন) অলির ব্যক্তিগত বাসভবনের দিকে রওনা দেন। পথে পুলিশ তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পিছু হটতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাধা উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হন। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা অলির বাসভবন প্রাঙ্গণে ঢুকে দুটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।
জেন-জি বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেপালি কংগ্রেস পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ ছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্যান্য মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতার বাড়ি ও প্রধান প্রধান দলীয় কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ললিতপুরে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুংয়ের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাউডেলের ভৈসেপাতির বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়া হয়।
গতকাল পদত্যাগ করা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের বাড়িতেও হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা।
নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নেপালি কংগ্রেসের প্রধান শের বাহাদুর দেউবার বুধানিলকণ্ঠার বাড়ির দিকে বিক্ষোভকারীরা এগোনোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়। বিরোধী দলের প্রধান ও সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র) চেয়ারম্যান পুষ্প কমল দহলের খুমলতার এলাকার বাসভবনেও আজ ইটপাটকেল ছোড়া হয়।
স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, বিভিন্ন এলাকায় মুখ্যমন্ত্রী, প্রাদেশিক মন্ত্রীসহ আরও বহু নেতার বাড়িঘর বিক্ষোভকারীদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া হয় মন্ত্রীদের
বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাসভবন ও দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষোভকারীদের হামলার জেরে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করলে আজ সেনা হেলিকপ্টারে করে ভৈসেপাতিতে মন্ত্রীদের বাসভবন থেকে তাঁদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেছেন, পার্লামেন্ট ভবনের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সামরিক ব্যারাকে নিরাপত্তা প্রদান করা হচ্ছে।
দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ
আগের দিন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারের আচরণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আজ সকালে প্রথমে পদত্যাগের ঘোষণা দেন নেপালের কৃষি ও পশুপালনমন্ত্রী রাম নাথ আধিকারী।
পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে রাম নাথ আধিকারী বিবিসি নেপালিকে বলেন, ‘গণতন্ত্রে প্রশ্ন করা ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করা নাগরিকদের সাধারণ অধিকার। অথচ আমরা দমন, হত্যাকাণ্ড আর বল প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র নয় বরং স্বৈরশাসনের দিকে এগোচ্ছি; এটি জেনে আমি হতবাক হয়েছি। যে প্রজন্মের দেশ গড়ার কাজে সহযোগিতা করার কথা, তাদের যুদ্ধের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে; এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। এর সমাধান না খুঁজে পদে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’
রাম নাথ আধিকারীর পর পদত্যাগপত্র জমা দেন নেপালের পানি সরবরাহমন্ত্রী প্রদীপ যাদব।
পদত্যাগপত্রে প্রদীপ লেখেন, সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জেন-জি তরুণদের প্রতি তিনি সমর্থন জানাচ্ছেন।
এই সাবেক মন্ত্রী লেখেন, ‘প্রিয় তরুণ ভাই-বোনেরা, আপনারাই আমার প্রথম সহযাত্রী এবং শক্তির উৎস। আমি সবার প্রতি শান্ত থাকার এবং তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত হতে সহায়তা করার আহ্বান জানাই।’
এর আগে বিক্ষোভ চলাকালে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে গতকাল পদত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক।
ত্রিভুবন বিমানবন্দর অচল
নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আজ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এ ঘটনায় যাত্রীদের সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
ত্রিভুবন বিমানবন্দরের (টিআইএ) মহাব্যবস্থাপক হংস রাজ পাণ্ডে বলেন, দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটের পর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। এর আগে কোটেশ্বর এলাকার কাছে ধোঁয়া দেখা যায়।
চলাচল সমস্যার কারণে বিমানকর্মীরা সময়মতো বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে কোনো ফ্লাইট ছাড়তে পারেনি। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দেশীয় বিমান সংস্থাগুলো সব ফ্লাইট স্থগিত করেছে। এর মধ্যে বুদ্ধ এয়ারও রয়েছে।
কেন এই বিক্ষোভ
গত সপ্তাহে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল অলির নেতৃত্বে থাকা নেপাল সরকার।
নতুন নিয়মনীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তবে নিয়ম মানায় টিকটকসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বিধিনিষেধের আওতার বাইরে ছিল।
সরকারের এ নিষেধাজ্ঞার ফলে নেপালের ব্যবসা ও পর্যটন খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রবাসে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় নাগরিকদের।
নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে গতকাল রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করেন নেপালের কয়েক হাজার মানুষ। কাঠমান্ডুসহ দেশটির অন্তত সাতটি শহরে এদিন ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে পুলিশের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়েন। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। একপর্যায়ে গুলিও চালানো হয়।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে গতকাল অন্তত ১৯ জন নিহত এবং প্রায় ৪০০ মানুষ আহত হন। সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় কাঠমান্ডুতে, সেখানে ১৭ জন নিহত হন। কাঠমান্ডুর বাইরে পোখারা, ভুটওয়াল, ভাইরাহাওয়া, ভরতপুর, ইতাহারি ও দামাক শহরে বিক্ষোভ করেছেন তরুণেরা।
তরুণদের বিক্ষোভের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। আজ দিনের শুরুতে নেপালের মন্ত্রিসভার মুখপাত্র এবং যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী পৃথিবী শুব্বা গুরুং নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার খবর জানান। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভ থামেনি।